রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১২

দুই বিঘা জমি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


দুই বিঘা জমি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে'
কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই -
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই
শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা -
ওটা দিতে হবে' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে'

পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে -
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য -
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।

নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি -
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ -
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে -
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।

ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার - এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ -
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন -
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী - হলে দাসী।।

বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি -
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন -
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।

হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি
কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব -
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব'
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ -
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন'
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ
আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে -
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।

বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১২

অবাক জলপানঃ সুকুমার রায়


অবাক জলপান

সুকুমার রায়    

পাত্রগণ : পথিক ঝুড়িওয়ালা প্রথম বৃদ্ধ দ্বিতীয় বৃদ্ধ ছোকরা খোকা মামা

প্রথম দৃশ্য

রাজপথ

   ছাতা মাথায় এক পথিকের প্রবেশ, পিঠে লাঠির আগায় লোট-বাঁধা পুঁটলি, উস্কোখুস্কো চুল, শ্রান্ত চেহারা

পথিক নাঃ । একটু জল না পেলে আর চলছে নাসেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখন‌‌ও প্রায় এক ঘণ্টার পথ বাকিতেষ্টায় মগজের ঘিলু শুকিয়ে উঠলকিন্তু জল চাই কার কাছে? গেরস্তের বাড়ি দুপুর রোদে দরজা এঁটে সব ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় নাবেশি চেঁচাতে গেলে হয়তো লোকজন নিয়ে তেড়ে আসবেপথেও ত লোকজন দেখছিনে ঐ একজন আসছে! ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক

পথিক মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?

ঝুড়িওয়ালা জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ ত জলপাইয়ের সময় নয়কাঁচা আম নিতে চান দিতে পারি

পথিক না না, আমি তা বলিনি

ঝুড়িওয়ালা না, কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা ত আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম

পথিক না হে আমি জলপাই চাচ্ছিনে

ঝুড়িওয়ালা চাচ্ছেন না ত 'কোথায় পাব' 'কোথায় পাব' কচ্ছেন কেন? খামকা এরকম করবার মানে কি?

পথিক আপনি ভুল বুঝেছেন আমি জল চাচ্ছিলাম

ঝুড়িওয়ালা জল চাচ্ছেন তো 'জল' বললেই হয়‒ 'জলপাই' বলবার দরকার কি? জল আর জলপাই কি এক হল? আলু আর আলুবোখরা কি সমান? মাছও যা মাছরাঙাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে এসে চালতার খোঁজ করেন?

পথিক ঘাট হয়েছে মশাইআপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে

ঝুড়িওয়ালা অন্যায় তো হয়েছেইদেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি তবে জল‌‌ই বা চাচ্ছেন কেন? ঝুড়িতে করে কি জল নেয়? লোকের সঙ্গে কথা ক‌‌ইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয়
  
ঝুড়িওয়ালার প্রস্থান

পথিক দেখলে! কি কথায় কি বানিয়ে ফেললে! যাক, ঐ বুড়ো আসছে, ওকে একবার বলে দেখি
  
লাঠি হাতে, চটি পায়ে চাদর গায়ে এক বৃদ্ধের প্রবেশ

বৃদ্ধ কে ও? গোপলা নাকি?

পথিক আজ্ঞে না, আমি পুবগাঁয়ের লোক একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম

বৃদ্ধ বল কিহে? পুবগাঁও ছেড়ে এখেনে এয়েছ জলের খোঁজ করতে? হাঃ, হাঃ, হাঃতা, যাই বল বাপু, অমন জল কিন্তু কোথাও পাবে নাখাসা জল, তোফা জল, চমৎ‌কা-র-র জল

পথিক আজ্ঞে হাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেছে

বৃদ্ধ তা তো পাবেইভালো জল যদি হয়, তা দেখলে তেষ্টা পায়, নাম করলে তেষ্টা পায়, ভাবতে গেলে তেষ্টা পায়তেমন তেমন জাল ত খাওনি কখনো! - বলি ঘুম্‌‌ড়ির জল খেয়েছো কোনোদিন?

পথিক আজ্ঞে না, তা খাইনি-

বৃদ্ধ খাওনি? অ্যাঃ! ঘুম্‌‌ড়ি হচ্ছে আমার মামাবাড়ি আদত জলের জায়গাসেখানকার যে জল, সে কি বলব তোমায়? কত জল খেলাম-- কলের জল, নদীর জল, ঝরণার জল, পুকুরের জল কিন্তু মামাবাড়ির কুয়োর যে জল, অমনটি আর কোথাও খেলাম নাঠিক যেন চিনির পানা, ঠিক যেন কেওড়া-দেওয়া সরবৎ‌!

পথিক তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন আপাতত এখন এই তেষ্টার সময়, যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে

বৃদ্ধ তাহলে বাপু তোমার গাঁয়ে বসে জল খেলেই ত পারতে? পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে জল খেতে আসবার দরকার কি ছিল? 'যা হয় একটা হলেই হল' ও আবার কি রকম কথা? আর অমন তচ্ছিল্য করে বলবারই বা দরকার কি? আমাদের জল পছন্দ না হয়, খেও না- বাস্‌‌গায়ে পড়ে নিন্দে করবার দরকার কি? আমি ওরকম ভালোবাসিনেহ্যাঃ-
  
রাগে গজগজ করিতে করিতে বৃদ্ধের প্রস্থান
  
পাশের এক বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হসিমুখ বাহির করণ

বৃদ্ধ কি হে? এত তর্কাতর্কি কিসের?

পথিক আজ্ঞে না, তর্ক নয়আমি জল চাইছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নেন না- কেবলই সাত পাঁচ গপ্‌‌প করতে লেগেছেনতাই বলতে গেলুম ত রেগে মেগে অস্থির!

বৃদ্ধ আরে দূর দূর! তুমিও যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাওনি? ও হতভাগা জানেই বা কি, আর বলবেই বা কি? ওর যে দাদা আছে, খালিপুরে চাকরি করে, সেটা ত একটা গাধাও মুখ্যুটা কি বললে তোমায়?

পথিক কি জানি মশাই- জলের কথা বলতেই কুয়োর জল, নদীর জল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল, 'লে পাঁচ রকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে--

বৃদ্ধ হুঁ! ভাবলে খুব বাহাদুরি করেছিতোমায় বোকা মতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছেভারি ত ফর্দ করেছেনআমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তা আমি এক্ষুনি পঁচিশটা বলে দেব-

পথিক আজ্ঞে হ্যাঁকিন্তু আমি বলছিলুম কি একটু খাবার জল

বৃদ্ধ কি বলছ? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা শুনে যাওবিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, জিবের জল, হুঁকোর জল, ফটিক জল, রোদে ঘেমে জ-ল, আহ্লাদে গলে জল, গায়ের রক্ত জল, বুঝিয়ে দিলে যেন জ-ল, কটা হয়? গোনোনি বুঝি?

পথিক না মশাই, গুনিনি আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই

বৃদ্ধ তোমার কাজ না থাকলেও আমাদের কাজ থাকতে পারে ত? যাও, যাও, মেলা বকিও নাএকেবারে অপদার্থের একশেষ!
  
বৃদ্ধের সশব্দে জানলা বন্ধ করণ

পথিক নাঃ, আর জলটল চেয়ে কাজ নেই এগিয়ে যাই, দেখি কোথাও পুকুরটুকুর পাই কি না
  
লম্বা লম্বা চুল, চোখে সোনার চশমা, হাতে খাতা পেন্সিল, পায়ে কটকী জুতা, একটি ছোকরার প্রবেশ

পথিক । (মনে মনে) লোকটা নেহাৎ‌ এসে পড়েছে যখন, একটু জিজ্ঞাসাই করে দেখি(জোরে) মশাই, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, এখানে একটু জল মিলবে না কোথাও?

ছোকরা কি বলছেন? 'জল' মিলবে না? খুব মিলবেএকশোবার মিলবে! দাঁড়ান, এক্ষুনি মিলিয়ে দিচ্ছি জল চল তল বল কল ফল, মিলের অভাব কি? কাজল-সজল-উজ্জ্বল জ্বলজ্বল-চঞ্চল চল্‌‌ চল্‌‌, আঁখিজল ছল্‌‌ছল্‌‌, নদীজল কল্‌‌কল্‌‌, হাসি শুনি খল্‌‌খল্‌‌, অ্যাঁকানল বাঁকানল, আগল ছাগল পাগল-- কত চান?

পথিক এ দেখি আরেক পাগল! মশাই, আমি সে রকম মিলবার কথা বলিনি

ছোকরা তবে কি রকম মিল চাচ্ছেন বলুন? কি রকম, কোন ছন্দ, সব বলে দিন যেমনটি চাইবেন তেমনটি মিলিয়ে দেব

পথিক ভালো বিপদেই পড়া গেল দেখছি (জোরে) মশাই! আর কিছু চাইনে, (আরো জোরে) শুধু একটু জল খেতে চাই!

ছোকরা ও বুঝেছিশুধু-একটু-জল-খেতে-চাইএই ত? আচ্ছা বেশএ আর মিলবে না কেন? শুধু একটু জল খেতে চাই, ভারি তেষ্টা প্রাণ আই-ঢাইচাই কিন্তু কোথা গেলে পাই, বল্‌‌ শীঘ্র বল্‌‌ নারে ভাইকেমন? ঠিক মিলেছে তো?

পথিক আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব মিলেছে, খাসা মিলেছে নমস্কার(সরিয়া গিয়া) নাঃ, বকে বকে মাথা ধরিয়ে দিলে একটু ছায়ায় বসে মাথাটা ঠাণ্ডা করে নি

একটা বাড়ির ছায়ায় গিয়া বসিল

ছোকরা (খুশী হ‌‌ইয়া লিখিতে লিখিতে) মিলবে না? বলি, মেলাচ্ছে কে? সেবার যখন বিষ্টুদাদা 'বৈকাল' কিসের সঙ্গে মিল দেবে খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন 'নৈপাল' বলে দিয়েছিল কে? নৈপাল কাকে বলে জানেন ত? নেপালের লোক হল নৈপাল(পথিককে না দেখিয়া) লোকটা গেল কোথায়? দুত্তোরি!
ছোকরার প্রস্থান

নেপথ্যে বাড়ির ভিতরে বালকের পাঠঃ পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থলসমুদ্রের জল লবণাক্ত, অতি বিস্বাদ!

পথিক ওহে খোকা! একটু এদিকে শুনে যাও তো?

রুক্ষমুর্তি, মাথায় টাক, লম্বা দাড়ি খোকার মামা বাড়ি হ‌‌ইতে বাহির হ‌‌ইলেন

মামা কে হে? পড়ার সময় ডাকাডাকি করতে এয়েছ? (পথিককে দেখিয়া) ও! আমি মনে করেছিলুম পাড়ার কোন ছোকরা বুঝিআপনার কি দরকার?

পথিক আজ্ঞে , জল তেষ্টায় বড় কষ্ট পাচ্ছি তা একটু জলের খবর কেউ বলতে পারলে না

মামার তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলিয়া দেওয়া

মামা কেউ বলতে পারলে না? আসুন, আসুনকি খবর চান, কি জানতে চান, বলুন দেখি? সব আমায় জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি

পথিককে মামার ঘরের মধ্যে টানিয়া নেওয়া

দ্বিতীয় দৃশ্য

ঘরের ভিতর

ঘর নানারকম যন্ত্র, নকশা, রাশি রাশি ব‌‌ই ইত্যাদিতে সজ্জিত

মামা কি বলছিলেন? জলের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না?

পথিক আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি

মামা আ হা হা! কি উৎ‌সাহ! শুনেও সুখ হয়এ রকম জানবার আকাঙ্খা কজনের আছে, বলুন ত? বসুন! বসুন! (কতকগুলি ছবি, ব‌‌ই আর এক টুকরা খড়ি বাহির করিয়া ) জলের কথা জানতে গেলে প্রথমে জানা দরকার, জল কাকে বলে, জলের কি গুণ

পথিক আজ্ঞে, একটু খাবার জল যদি......

মামা আসছে ব্যস্ত হবেন নাএকে একে সব কথা আসবেজল হচ্ছে দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন

মামা বোর্ডে খড়ি দিয়া লিখিলেন H2 + O = H2O

পথিক (মনে মনে) এই মাটি করেছে!

মামা বুঝলেন? রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জলকে বিশ্লেষণ করলে হয় হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনআর হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের রাসায়নিক সংযোগ হলেই হল জল! শুনছেন তো?

পথিক আজ্ঞে হ্যাঁ, সব শুনছিকিন্তু একটু খাবার জল যদি দেন, তাহলে আরো মন দিয়ে শুনতে পারি

মামা বেশ ত! খাবার জলের কথাই নেওয়া যাক নাখাবার জল কাকে বলে? না, যে জল পরিস্কার, স্বাস্থকর, যাতে দুর্গন্ধ নাই, রোগের বীজ নাইকেমন? এই দেখুন এক শিশি জল আহা, ব্যস্ত হবেন নাদেখতে মনে হয় বেশ পরিস্কার, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে যদি দেখেন, দেখবেন পোকা সব কিলবিল করছেকেঁচোর মতো, কৃমির মতো সব পোকা এমনি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুবীক্ষন দিয়ে দেখায় ঠিক এত্তো বড় বড়এই বোতলের মধ্যে দেখুন, ও বাড়ির পুকুরের জল; আমি এইমাত্র পরীক্ষা করে দেখলুম; ওর মধ্যে রোগের বীজ সব গিজ্‌‌গিজ্‌‌ করছে প্লেগ, ট‌‌ইফয়েড, ওলাউঠা, ঘেয়োজ্বর ও জল খেয়েছেন কি মরেছেন! এই ছবি দেখুন এইগুলো হচ্ছে কলেরার বীজ, এই ডিপথেরিয়া, এই নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া সব আছেআর এই সব হচ্ছে জলের পোকা জলের মধ্যে শ্যাওলা ময়লা যা কিছু থাকে ওরা সেইগুলো খায়আর এই জলটার কি দুর্গন্ধ দেখুন! পচা পুকুরের জলছেঁকে নিয়েছি, তবু গন্ধ

পথিক উঁ হুঁ হুঁ হুঁ! করেন কি মশাই? ওসব জানবার কিচ্ছু দরকার নেই

মামা খুব দরকার আছেএসব জানতে হয় অত্যন্ত দরকারী কথা!

পথিক হোক দরকারী! আমি জানতে চাইনে, এখন আমার সময় নেই

মামা এই ত জানবার সময়আর দুদিন বাদে যখন বুড়ো হয়ে মরতে বসবেন, তখন জেনে লাভ কি? জলে কি কি দোষ থাকে, কি করে সে সব ধরতে হয়, কি করে তার শোধন হয়, এসব জানবার মতো কথা নয়? এই যে সব নদীর জল সমুদ্রে যাচ্ছে, সমুদ্রের জল সব বাস্প হয়ে উঠছে, মেঘ হচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছেএরকম কেন হয়, কিসে হয়, তাও ত জানা দরকার?

পথিক দেখুন মশাই! কি করে কথাটা আপনাদের মাথায় ঢোকাব তা ত ভেবে পাইনেবলি, বারবার করে বলছি তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, সেটা ত কেউ কানে নিচ্ছেন না দেখিএকটা লোক তেষ্টায় জল-জল করছে তবু জল খেতে পায় না, এরকম কোথাও শুনেছেন?

মামা শুনেছি বৈকি! চোখে দেখেছিবদ্যিনাথকে কুকুরে কামড়াল, বদ্যিনাথের হল হাইড্রোফোবিয়া যাকে বলে জলাতঙ্কআর জল খেতে পারে না যেই জল খেতে যায় অমনি গলায় খিঁচ ধরে যায়মহা মুশকিল! শেষটায় ওঝা ডেকে, ধুতুরো দিয়ে ওষুধ মেখে খওয়ালো, মন্তর চালিয়ে বিষ ঝাড়ল তারপর সে জল খেয়ে বাঁচলওরকম হয়

পথিক (মনে মনে) নাঃ! এদের সঙ্গে আর পেরে ওঠা গেল না কেন‌‌ই বা মরতে এসেছিলাম এখেনে? (জোরে) বলি, মশাই, আপনার এখানে নোংরা জল আর দুর্গন্ধ জল ছাড়া ভালো খাঁটি জল কিছু নেই?

মামা আছে বৈকি! এই দেখুন না বোতলভরা টাটকা খাঁটি 'ডিস্টিল ওয়াটার' যাকে বলে 'পরিশ্রুত জল'

পথিক (ব্যস্ত হ‌‌ইয়া) এ জল কি খায়?

মামা না, ও জল খায় না ওতে স্বাদ নেই একেবারে বোবা জল কিনা, এইমাত্র তৈরি করে আনল এখনো গরম রয়েছে
 
পথিকের হতাশ ভাব

মামা । তারপর যা বলছিলাম শুনুন এই যে দেখছেন গন্ধওয়ালা নোংরা জল এর মধ্যে দেখুন এই গোলাপী জল ঢেলে দিলুম বাস, গোলাপী রঙ উড়ে শাদা হয়ে গেলদেখলেন ত?

পথিক না মশাই, কিচ্ছু দেখিনি কিচ্ছু বুঝতে পারিনি কিচ্ছু মানি না কিচ্ছু বিশ্বাস করি না

মামা কি বললেন! আমার কথা বিশ্বাস করেন না?

পথিক না, করি নাআমি যা চাই, তা যতক্ষণ দেখাতে না পারবেন, ততক্ষণ কিচ্ছু শুনব না, কিচ্ছু বিশ্বাস করব না

মামা বটে! কোনটা দেখতে চান একবার বলুন দেখিআমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি

পথিক তাহলে দেখান দেখিশাদা, খাঁটি চমৎ‌কার, ঠাণ্ডা, এক গেলাশ খাবার জল নিয়ে দেখান দেখিযাতে গন্ধপোকা নেই, কলেরার পোকা নেই, ময়লাটয়লা কিচ্ছু নেই, তা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখান দেখিখুব বড় এক গেলাশ ভর্তি জল নিয়ে আসুন ত

মামা এক্ষুনি দেখিয়ে দিচ্ছি! ওরে ট্যাঁপা, দৌড়ে আমার কুঁজো থেকে এক গেলাশ জল নিয়ে আয় ত

পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দে খোকার দৌড়

মামা । নিয়ে আসুক তারপর দেখিয়ে দিচ্ছিঐ জলে কি রকম হয়, আর এই নোংরা জলে কি রকম তফাৎ‌ হয়, সব আমি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছি
  
জল ল‌‌ইয়া ট্যাঁপার প্রবেশ

মামা । রাখ এইখানে রাখ

জল রাখিবামাত্র পথিকের আক্রমণ মামার হাত হ‌‌ইতে জল কাড়িয়া এক নিঃশ্বাসে চুমুক দিয়া শেষ করা

পথিক আঃ! বাঁচা গেল!

মামা (চটিয়া) এটা কি রকম হল মশাই?

পথিক পরীক্ষা হল! এক্সপেরিমেন্ট! এবার আপনি নোংরা জলটা একবার খেয়ে দেখান ত, কি রকম হয়?

মামা (ভীষণ রাগিয়া) কি বললেন!

পথিক আচ্ছা থাক, এখন নাই বা খেলেন পরে খবেন এখনআর এই গাঁয়ের মধ্যে আপনার মতো আনকোরা পাগল আর যতগুলো আছে, সব কটাকে খানিকটা করে খা‌‌ইয়ে দেবেনতারপর খাটিয়া তুলবার দরকার হলে আমার খবর দেবেন আমি খুশী হয়ে ছুটে আসব হতভাগা জোচ্চোর কোথাকার!

পথিকের দ্রুত প্রস্থান

পাশের গলিতে কে সুর করিয়া হাঁকিতে লাগিল, অবাক জলপান